প্রাসঙ্গিক তথা
নারিকেল একটি বহুবর্ষজীবী, একবীজ পত্রী, এক কাণ্ড বিশিষ্ট গুচ্ছমূল উদ্ভিদ। নারিকেলের জাত গুলোকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় । যথা- (১) টিপিকা জাত (লম্বা শ্রেণি) (২) জাভানিকা জাত (মাঝারী লম্বা শ্রেণি) এবং (৩) বামন বা নানা জাত (খাটো শ্রেণি) । নারিকেলের বংশ বিস্তারের জন্য উৎকৃষ্ট গুণাবলি সম্পন্ন মাতৃগাছ নির্বাচন করা উচিত । নারিকেলের বংশ বৃদ্ধি বীজ দ্বারা হয়ে থাকে । নারিকেলের বীজ থেকে উন্নতমানের চারা উৎপাদন করে বাগানে রোপণ করতে হয় ।
উপকরণ
(১) বীজ (২) সার (জৈব ও রাসায়নিক) (৩) কীটনাশক (৪) ছত্রাকনাশক (৫) প্রে যমত্র (৬) পানি (৭) ঝাঝরি (৮) লাঙল (৯) জোয়াল (১০) মই (১১) মুগুর (১২) খুরপি (১৩) কোদাল (১৪) ঝুড়ি (১৫) দা (১৬) রশি (১৭) বস্তা (১৮) বেড়া ।
নারিকেল চাষ করার জন্য নিম্নের কাজ/ ধাপ অনুসরণ করতে হবে।
১। নারিকেলের উন্নত জাত নির্বাচন করুন। নির্বাচিত মাতৃগাছ থেকে সতেজ, সুপক্ক, খোসাসহ, শাস পুরু, বড়, যথেষ্ট পানি আছে, কীট/রোগ মুক্ত এমন ফল (১৫০টি/হেক্টরে) সংগ্রহ করুন ।
২। নারিকেলের জন্য উঁচু স্থান এবং সুনিষ্কাশিত উর্বর দোঁআশ/এঁটেল দোআশ/বেলে দোআশ মাটি নির্বাচন করুন।
৩ । চারা তৈরির জন্য সেচ নিকাশের সুবিধাযুক্ত স্থানে বেলে দোঁআশ ধরনের মাটিতে গভীরভাবে চাষ করে ২মি (৬) প্রস্থ ও ৩ মি. (১০) লম্বা ও ১৫-১২ সেমি. উঁচু করে (২/৩টি) বীজতলা তৈরি করুন। প্রতি বীজতলায় ৭৫/৯০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০-১২০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করে ভালভাবে মিশিয়ে দিন। সংগৃহীত বীজ এক মাসের মধ্যেই রোপণ করুন । বীজের মুখের খোসাটি খুলে ফেলুন। প্রতি বীজতলায় ৩০ সে.মি দূরত্বে সারি টেনে ৩০ সে.মি পরপর পার্শ্ব ভাবে চিত্র (দ্রষ্টব্য) বীজ বপন (৪০/৫০ টি) করুন। বীজ সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে না ঢেকে পিঠের সামাণ্য খোলা রাখুন । বীজ বপনের পর বীজতলা খড়কুটা/নারিকেলের পাতা/ ছোবড়া দ্বারা ঢেকে দিন । বৃষ্টি না হলে একদিন পরপর ঝাঝরি দিয়ে সেচ দিন । বীজতলায় আগাছা জন্মালে নিড়িয়ে তুলে ফেলুন । এভাবে যত্ন করে ৩/৪ মাসের মধ্যে চারা না গজালে তা বাতিল করে তুলে ফেলুন । ৯-১২ মাস বয়ক সুস্থ সবল চারা জমিতে রোপণের জন্য বাছাই করুন ।
৪ । নারিকেলের জমি লাঙল দিয়ে ভালভাবে ৩/৪ টি চাষ ও মই দিন । মুগুর দিয়ে ঢেলা ভেঙে দিন । আগাছা বেছে ফেলুন । জমি সমতল করে নিন ।
৫। জমিতে ৯ মি. (২৭) দূরত্বে কোদাল দিয়ে ১ মি. চওড়া ও ১ মি গভীর করে গর্ত তৈরি করুন। গর্ত সপ্তাহকাল খোলা রেখে দিন। গর্তের তলায় ১০/১৫ সে.মি পুরু করে নারিকেলের ছোবড়া/তুষ বিছিয়ে দিন। এরপর প্রতি গর্তে ১৫ কেজি জৈব সার, ৪৫০ গ্রাম টিএসপি, ৩০ গ্রাম এমপি ও ৫ কেজি ছাই মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখুন। গর্ত ভরাট করার সময় উপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি উপরে দিন। এর ১০/১৫ দিন পর চারা রোপণ করে দিন ।
৬। রোপণের জন্য বীজতলা থেকে সুস্থ ও সতেজ, পাতা গাঢ় সবুজ, বোটা খাট ও প্রশস্ত এমন অঙ্কুরিত চারা নির্বাচন করুন । বীজতলা থেকে দুহাতে ধরে চারা সাবধানে তুলে আনুন । প্রতি গর্তের মাঝখানে বীজের পিঠের কিছু অংশ খোলা রেখে চারা পুতে দিন। চারা স্থানান্তরের জন্য ঝুড়ি ব্যবহার করুন। হাতে চেপে মাটি বসিয়ে দিন । একটি চারা পুঁতে রশি দিয়ে বেঁধে দিন। চারা বেড়া দিয়ে ঘিরে দিন । চারা লেগে না উঠা পর্যন্ত রসের অভাব হলে সপ্তাহে ঝাঝরি দিয়ে ২/১ টি সেচ দিন। রোপণের পর ছায়া দানের ব্যবস্থা করুন ।
৭ । চারা গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে নিড়িয়ে তুলে ফেলুন। চারা বাড়ার সাথে নিড়ানি এলাকার পরিসরও বাড়ান । সেচের পর মাটিতে জো এলে মাটির চটা ভেঙে দিন। মাটি আলগা রাখুন। বয়স্ক গাছ মাঝে মাঝে নিড়িয়ে আগাছা মুক্ত করুন ।
৮। নারিকেলের চারা রোপণের পর প্রতি বছর ৫ কেজি জৈব সার, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করুন । ৫ বছর ও তদুর্ধ বয়স্ক গাছে ১০ কেজি জৈব সার, ইউরিয়া ৮৭০ গ্রাম, টিএসপি ৩২৫ গ্রাম ও এমপি ১.১৪ কেজি প্রয়োগ করুন ।
৯ । এসব সার বছরে দুই দফায় অর্ধেক বর্ষার আগে ও অর্ধেক বর্ষার পরে গাছে প্রয়োগ করুন। গাছের গোড়া (৪০-৬০ সে.মি বাদ রেখে) থেকে ১.০-১.৫ মি দূর পর্যন্ত (দুপুরে যতটুকু স্থানে রৌদ্রের ছায়া পড়ে) মাটি লাঙ্গাল/কোদাল দিয়ে আলগা করে সারগুলি ভালোভাবে মিশিয়ে দিন। সার প্রয়োগের পর গাছে পাবন/থালা সেচ দিন । চারা গাছে সপ্তাহে ঝাঝরি দিয়ে ২/১ টি সেচ দিন এবং বয়স্ক গাছে বর্ষার পরে ১০/১৫ দিন পরপর পাবন/থালা পদ্ধতিতে সেচ দিন। বর্ষায় নিকাশের ব্যবস্থা করুন।
১০ । মরা, রাগাক্রান্ত, ভেঙে যাওয়া ডালপালা কেটে ফেলুন। হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাওয়া ডাল কেটে ফেলুন । বছরে ২/১ বার গাছ খুব সাবধানে পরিষ্কার করে দিন। শুষ্ক মৌসুমে মাটির রস সংরক্ষণ ও পরিবেশ ঠান্ডা রাখার জন্য গাছের গোড়ার চারদিকে যতদূর ছায়া পড়ে ততটুকু কচুরিপানা/নারিকেলের পাতা বা ছোবড়া দিয়ে ঢেকে দিন । বর্ষাকালে কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ায় কিছু মাটি তুলে উঁচু করে দিন ।
১১ । গন্ডার পোকা দমনে পোকার গর্তে তার ঢুকিয়ে দিয়ে পোকা বের করে এনে মেরে ফেলুন। (২) আক্রান্ত মরা গাছ ধ্বংস করুন । (৩) সিরিঞ্জ দিয়ে (১ সিসি) কীটনাশক (ডায়জিনন/ মেটাসিসটক্স) গর্তে ঢুকিয়ে পোকা মারুন । (৪) আলকাতরা / তারপিন তেল/ কেরোসিন তেল গর্তে ঢুকিয়ে দিন । কাদা দ্বারা গর্তের মুখ বন্ধ করে রাখুন । (৫) বাগানে গোবর/আবর্জনা জমতে দিবেন না ।
১২। লাল পোকা উইভিল দমনে পঁচা খৈলের ফাদ পেতে পোকা ধরে মারার জন্য একটি খোলা পাত্রে পচা খৈল গর্তের মুখের কাছে রেখে দিন। পোকা বের হয়ে আসলে ধরে মেরে ফেলুন। ২/২০ গ্রাম সেভিন পাউডার ১ লিটার পানিতে গুলে সিরিঞ্জ দিয়ে গর্তে ঢুকিয়ে দিয়ে পোকা মেরে ফেলুন ।
১৩ । কালোমাথা শুয়া পোকা দমনে- (১) আক্রান্ত পাতা ধ্বংস করুন, (২) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ ডায়াজিনন ৬০ তরল কীটনাশক গুলে গাছের পাতায় ভালোভাবে স্প্রে করে দিন ।
১৪ । উইপোকা দমনে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪/৫ চা চামচ ডায়াজিনন ৬০ তরল গুলে মাটি আলগা করে গাছের গোড়াসহ মাটিতে ভালোভাবে স্প্রে করে দিন ।
১৫ । ইদুর দমনে- (১) আশে-পাশে গর্ত থেকে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলুন, (২) টিনের তৈরি প্রতিন্ধক তৈরি করে গাছের কাণ্ডে লাগিয়ে ইদুরের গাছে উঠা বন্ধ করে দিন ।
১৬ । কুঁড়ি পচা রোগ দমনে- (১) আক্রান্ত মরা গাছ ধ্বংস করে ফেলুন, (২) প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪০/৪৫ গ্রাম ডাইথেন-এম-৪৫/ কুপ্রাভিট পাউডার গুলে নিয়ে গাছ, পাতা, কুঁড়িতে ভালোভাবে স্প্রে করে দিন ।
১৭ । ফল পচা ও ভূয়ো নারিকেল দমনে- (১) প্রতি বছর নিয়মিত সার ব্যবহার করুন, (২) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পানোফিক্স গুলে গাছে ভালোভাবে স্প্রে করে দিন ।
১৮ । পাতায় দাগ দমনে-১৬ (২) নং অনুরূপ ব্যবস্থা নিন ।
১৯ । ছোট পাতা রোগ দমনে নিয়মিত ও পরিমিত সেচ সার প্রয়োগ করুন ।
২০ । কাণ্ডের রস ঝরা রোগ দমনে ক্ষতস্থান বেছে পরিষ্কার করে আলকাতরা / বোর্দোপেষ্ট লাগিয়ে দিন ।
২১ । শিকড় পচা রোগ দমনে (১) নিয়মিত ও পরিমিত সেচ সার প্রয়োগ করুন এবং নিকাশের ব্যবস্থা নিন, (২) গাছের গোড়া থেকে কিছু মাটি সরিয়ে ১৬ (২) এর অনুরূপভাবে প্রে করুন ।
২২ । ডাব হিসেবে ব্যবহারের জন্য কচি ফল আরোলা দা দিয়ে কেটে সংগ্রহ করুন। এছাড়া সম্পূর্ণ পরিপক্ক ঝুনা নারিকেল সংগ্রহ করুন। সংগৃহীত ফল ভাল-মন্দ, ছাট-বড় বাছাই করে নিন । নারিকেল তৈল/কাপরা করে সংরক্ষণ করতে পারেন । এছাড়া ঝুনা নারিকেল ঘরে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন বহুদিন ।
সতর্কতা
১। বীজের মুখের খোসাটি সরিয়ে ফেলা কর্তব্য । তাতে গজানো সহজ হয় ।
২। পাঁচ মাস পরে না গজানো চারা বাতিল করে নতুন বীজ লাগানো ভালো ।
৩। রোপণের এক বছর পর যদি কোন চারা না বাড়ে তবে তা তুলে ফেলে নতুন চারা রোপণ করা উচিত।
৪ । অন্য সব পরিচর্যা ঠিক থাকলেও (সেচ / সার কীট ও রোগ দমন শুধু পরাগায়ণের অভাবেও ফল ঝরে পড়তে পারে।
৫। গল্ডার ও লাল পোকা থেকে সতর্ক থাকতে হবে ।
Read more